ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৯ মাস পর রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এবার একই পথের পথিক হতে যাচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দীর্ঘ রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টি। ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের আওয়াজ চাউর হচ্ছে রাজপথে। বার বার আওয়ামী লীগের ক্ষমতার বাহন জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষক মহল।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর শুরুতে সেনাবাহিনী ও পরে অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে ডাক পাওয়া জাপা’র জন্য সুবর্ণ সুযোগ ছিল। কিন্তু দলটির নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে তারা রাজনীতি থেকে ছিটকে যান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপে সর্বশেষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা জাপাকে ডাকেননি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে জাপা’র রাজনৈতিক কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর শুরুতে ফুরফুরে মেজাজে ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনি জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি। তবে সেই পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগেনি। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গঠিত এই দলটি এখন রাজনীতিতে একঘরে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নিষিদ্ধের চাপে এখন দিশেহারা দলটি। এমন চাপে দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রমও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বনানী অফিসের চার দেয়ালের ভেতরে নামমাত্র কর্মসূচি ও প্রেস রিলিজে চলছে তাদের কার্যক্রম। তবে শেষ রক্ষা হয়নি সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পাটির।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত কারার পরপরই জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়েছে জুলাই ঐক্য। এ ছাড়া আরও কয়েকটি দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যানটিনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান তারা। জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণকারী সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনের জোট হিসেবে পরিচিত জুলাই ঐক্য। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা। দলটির নিবন্ধন চিরতরে বাতিল করা (মাত্র স্থগিত রাখা যথেষ্ট নয়) এবং আওয়ামী লীগের সব সহযোগী সংগঠনকে (রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং স্থগিত করায় সরকারকে স্বাগত জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জুলাই ঐক্য প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সংগঠক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে গেজেট প্রকাশ এবং নির্বাচন কমিশন থেকে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের দাবি পূরণে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছে। স্পষ্ট করে বলতে চাই, ছাত্র-জনতার মূল দাবি ছিল আ’লীগকে দল হিসেবে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করা এবং তাদের নিবন্ধন সম্পূর্ণ বাতিল করা। সাময়িক স্থগিতাদেশ সেই দাবির পূর্ণ প্রতিফলন নয় বলে আমরা মনে করি। এ সময় তারা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টি বিগত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের মূল সহযাত্রী হিসেবে কাজ করেছে। এই রাজনৈতিক শক্তিগুলোও দায়মুক্তি পেতে পারে না। আমরা এসব দলের নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধকরণ এবং বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই।
সংবাদ সম্মেলনে কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিয়ে মুসাদ্দিক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দেয়া ওয়াদার ভিত্তিতে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে দিতে হবে, নাহলে ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে সব দাবি আদায়ে এগিয়ে যাবে জুলাই ঐক্য।
এরআগে ১২ মে দুপুরে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত কারার পরপরই জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানায় গণঅধিকার পরিষদ। গত সোমবার দুপুরে দলের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান এ দাবি তোলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন দলটির সভাপতি নুরুল হক নুর। লিখিত বক্তব্যে রাশেদ খান বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তাই এবার আওয়ামী লীগের সহযোগী জাতীয় পার্টির নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, গণঅধিকার পরিষদ মনে করে, শুধু সাংগঠনিক নিষেধাজ্ঞা নয়, আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত নিবন্ধন বাতিল না হলে এই গণ-অভ্যুত্থান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিবন্ধন বাতিল এবং চূড়ান্তভাবে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে নির্বাচন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করেন তারা। এ সময় জাতীয় পার্টির নিবন্ধন বাতিলে আজ সোমবার নির্বাচন কমিশনে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়ার ঘোষণা দেন। এরআগে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটভুক্ত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে লিখিত আবেদনপত্র জমা দেয় গণঅধিকার পরিষদ। এদিন সংগঠনটির সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আসে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন, উচ্চতর পরিষদ সদস্য আবু হানিফ, শাকিল উজ্জামান, মাহফুজুর রহমান খান, হাবিবুর রহমান রিজু, যুব অধিকার পরিষদের সভাপতি মনজুর মোর্শেদ মামুন।
গণঅধিকার পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, গত ১০ মে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। একইভাবে তাদের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দল দেশের নাগরিকদের ওপর চালানো গণহত্যাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে গণহত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এছাড়া দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করে গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ যে একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছিল, তার অন্যতম সহযোগী ও বৈধতা দানকারী হিসেবে সক্রিয় ছিল জাতীয় পার্টিসহ জোটবদ্ধ বাকি দলগুলো। বিগত তিনটি একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টি। হাসান আল মামুন বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরপর তিনটি নির্বাচনে জনগণকে ভোট দিতে না দেয়া, গুম, ক্রসফায়ার, আয়নাঘরে নির্যাতন, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রতিবেশী দেশের হাতে তুলে দেয়া, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করাসহ বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশের ওপর চালানো বর্বর আওয়ামী দুঃশাসনের ভিত্তিকে শক্তিশালী করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের মৌলিক মানবাধিকার হরণের মাধ্যমে তারা নিজেদের রাষ্ট্রদ্রোহী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ওপর নির্মম বর্বরতা চালানো ও ধারাবাহিক দুঃশাসনের প্রধান হোতা আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গী প্রত্যেকটি দলকে গণহত্যা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে যথাযথ শাস্তির মুখোমুখি করার আহ্বান করছে গণঅধিকার পরিষদ।
এদিকে রাজনৈতিক নিষিদ্ধের ঝুঁকির বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার মনিরুল ইসলাম বলেন, সরকার যেভাবে আগাচ্ছে তাতে জাতীয় পার্টির জন্য ঝুঁকি তো আছেই। তবে একথা সবার মনে রাখতে হবে কোনো দলের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করা রাজনৈতিক সমাধান নয়। তিনি বলেন- যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার হবে, একটা দলের সব নেতাকর্মী সমর্থক তো আর অপরাধ করেনি। তবে জাতীয় পার্টির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার নেতা দাবিদার বিদিশা এরশাদ বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর জিএম কাদের জাতীয় পার্টির অবৈধ চেয়ারম্যান। তাকে অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, এইচ এম এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি তৃণমূল নেতাকর্মীরাই পুনর্গঠন করবে।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ সরকারের দমনপীড়ন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদন ভয়ংকর বীভৎসতার তথ্যসংবলিত। প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ উত্থাপন করেছে জাতিসংঘ। সুতরাং আ’লীগের অপকর্ম প্রমাণিত। তবে জাতীয় পার্টির অপকর্ম নিশ্চিতভাবে এখনো প্রমাণিত হয়নি। সেক্ষত্রে, আ’লীগের আমলে জাতীয় পার্টি ১৪, ১৮ এবং ২৪ এর নির্বাচনে কি ধরনের ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের খুন হত্যা নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল যাচাই-বাছাই করতে তদন্ত কমিটি হবে। তদের তথ্য অনুযায়ী যতটা দোষী জাতীয় পার্টি হবে তার বিচার দাবি করবে এনসিপি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* মধুর ক্যান্টিনের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে জুলাই ঐক্যের নেতারা * আ’লীগ-জাপা ও ১৪ দলের নিবন্ধন বাতিল চায় গণঅধিকার পরিষদ
নিষিদ্ধের ঝুঁকিতে জাতীয় পার্টি
- আপলোড সময় : ১৪-০৫-২০২৫ ০৬:৩৬:৩৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৪-০৫-২০২৫ ০৬:৩৬:৩৪ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ